Banner 728x90

উন্নয়ন ও অগ্রগতি: আমরা কতটা সফল, কতটা ব্যর্থ

 

উন্নয়ন ও অগ্রগতি: আমরা কতটা সফল, কতটা ব্যর্থ





বাংলাদেশের ব্যাপারেও বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে এই বলে যে তারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়েছে বা বানানোর চেষ্টা করেছে। প্রশ্ন হলো, কোনো একটা রাষ্ট্রকে আমরা কেন ব্যর্থ রাষ্ট্র বলি? একটা রাষ্ট্র গঠনের পেছনে বেশ কিছু উদ্দেশ্য থাকে। রাষ্ট্র একটা সংগঠন। এই সংগঠনে অনেক ব্যক্তি সমবেত হন। এখন এই সংগঠন যদি ব্যক্তির কাজে লাগে, তাহলে তাঁরা সংগঠনটিকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন, যাতে করে তাঁরা এ থেকে আরও বেশি করে উপকার পান।আর যখন দেখবেন, যে উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না, তখন তাদের মধ্যে অতৃপ্তি, ক্ষোভ, হতাশা দেখা দেবে। রাষ্ট্র এই অর্থে ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে যে জাগতিক বিষয়গুলো নাগরিকদের কাছে সরবরাহ করার কথা, সেখানে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলেই ব্যর্থতার প্রশ্নগুলো ওঠে। ঘাটতির পরিমাণ যত কমে আসবে, মানুষ ততই রাষ্ট্রকে সফল বলে ভাবতে পারে। ঘাটতির পরিমাণ যতই বাড়তে থাকবে, ততই মানুষ বলবে রাষ্ট্র ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ৫৩ ছাড়িয়ে ৫৪-তে পড়ছে। পাঁচ দশক কিন্তু একটা রাষ্ট্রের জীবনে কম নয়। একসময় আমরা পাকিস্তানের মধ্যে ছিলাম। সেই রাষ্ট্রের ২৩ বছর না যেতেই আমরা অতৃপ্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ অর্জন করি। এ ক্ষেত্রে প্রধান যুক্তিটা ছিল যে পাকিস্তান আমাদের জন্য ব্যর্থ রাষ্ট্র ছিল। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্র, আমাদের জনপদের যে জনগোষ্ঠী যেটা আশা করেছিল, সেটা দিতে পারেনি।আমরা পাঁচ দশকের বেশি সময় আগে যে রাষ্ট্রটি তৈরি করেছি, সেটা কতটুকু সামনের দিকে যাচ্ছে অথবা আদৌ যাচ্ছে কি না অথবা বারবার তার উত্থান-পতন হচ্ছে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন। অথবা আমরা যদি বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি কোন দিকে যাচ্ছে, তার একটা লেখচিত্র আঁকি, তাহলে সেই রেখাটি কি ঊর্ধ্বগামী নাকি ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল নাকি নিম্নগামী হচ্ছে? 

এটা বুঝতে হলে আমাদের কতগুলো নির্ণায়ক ব্যবহার করতে হয়। এই নির্ণায়কগুলো বাছাই করার ক্ষেত্রে শাসকদের একধরনের চালাকি বা মুনশিয়ানা থাকতে পারে। আমরা যদি বলি, ১৯৭২ সালে দেশে এতগুলো বিদ্যুতের খুঁটি ছিল, আর এখন তা বেড়ে এত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারব আমাদের এক শ, দুই শ, হাজার গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু এই নির্ণায়কগুলো ব্যবহার করে আমরা একধরনের ঊর্ধ্বগামী রেখা দেখাতে পারি।

কিন্তু আমরা যে বাংলাদেশটি তৈরি করলাম, তার বয়স তো পাকিস্তান আমলে আমরা যত দিন পাকিস্তান রাষ্ট্রে ছিলাম, তার দ্বিগুণের বেশি। এত দিনে তাহলে আমাদের অর্জনগুলো কী বা কোথায় কোথায় আমাদের ঘাটতি আছে—এগুলোর একটা বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা, মূল্যায়ন হতেই পারে। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বাগাড়ম্বর করি।পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি শাসকেরা বাগাড়ম্বর করে বলতেন, পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে, পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই এসেছে। একসময় পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলা হতো। পরে স্লোগানটি বদলে বলা শুরু হলো পাকিস্তান পায়েন্দেবাদ, মানে পাকিস্তান চিরজীবী হোক। আমরাও এখন বলি বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। কিন্তু আমাদের ঘোষণায় কিংবা স্লোগানেই তো শুধু বাংলাদেশ চিরজীবী হয়ে যাবে না।


কিন্তু আবার বাংলাদেশকে নানান ক্ষেত্রে লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও পড়তে হচ্ছে। ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে আমরা ঘোষণা দিয়ে দিলাম যে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি জানি না, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বলতে তাঁরা কী বোঝেন। বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমাদের প্রতিবছর আমদানি করতে হচ্ছে। মাঝখানে আমরা সমস্ত জোর দিলাম ধান উৎপাদনের দিকে। কেননা মানুষকে ভাত খাওয়াতে পারলে মানুষ ঠান্ডা থাকবে—এই ধারণা থেকে রাজনীতিবিদেরা কৃত্রিম উপায়ে বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা সব সময় করেন।

আমরা বলছি পদ্মা সেতু করেছি, মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনটা কী? হ্যাঁ, আমাদের টাকায় এগুলো আমরা করেছি। কিন্তু আমরা তো আরেকটা পদ্মা সেতু বা স্যাটেলাইট নিজেরা তৈরি করার জন্য বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে যে সক্ষমতা দরকার, তা অর্জন করতে পারছি না। ৫৪ বছরে এসে আমাদের প্রশ্নটা জাগতেই পারে, আমরা যে জন্য দেশটি তৈরি করেছিলাম, দেশটি স্বাধীন করেছিলাম, দেশটা কি সেই পথে আছে?

কখনো উৎপাদন বাড়ানোর মধ্য দিয়ে, কখনো রেশনিংয়ের মধ্য দিয়ে, কখনো খোলাবাজারে চাল বিক্রি করে, কখনো ভর্তুকি দিয়ে, কখনো কাজের বিনিময়ে খাদ্য—এ রকম নানান কারিকুরি করে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা হয়। চালের দাম বেড়ে গেলে দেশে নানা হইচই হয়। তাতে সরকার মনে করে যে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যত কিছু হোক চালের দামটা স্থিতিশীল রাখতেই হবে।



আমরা খাদ্যে বা খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যে দাবি করেছিলাম, সেটা একদম বাগাড়ম্বরে পরিণত হয়েছে। শুধু চাল নয়, গম, ডাল, মসলা, চিনি—প্রায় সব খাদ্যপণ্যই আমাদের আমদানি করতে হবে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমদানিনির্ভরতা তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ নিয়ে যখন মাতম ওঠে, সেখানেই বোঝা যায় আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের স্লোগানটি কতটা ভঙ্গুর। এ ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, ৫৩-৫৪ বছরের আমাদের অর্জন কতটা।একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত টেকসই অর্থনীতি। যে অর্থনীতি ঠুনকো আঘাতে ভেঙে পড়বে না। কিছুদিন আগে আমাদের নেতারা সমস্বরে বলা শুরু করলেন যে আমাদের সব দুর্গতির মূল কারণ ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ। 


আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে সব ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। আমদানি করার মতো বিদেশি মুদ্রা যদি আমাদের থাকে, তাহলে সেটা দোষের কিছু নয়। সেই অর্থটা আসতে হবে নানা কিছু রপ্তানি করে। গত ৫৩-৫৪ বছরে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, প্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রেই এই বিদেশ–নির্ভরশীলতা বেড়েছে। 


No comments

Powered by Blogger.